সঙ্গীতের যুক্তালঙ্কার , শ্রেষ্ঠালঙ্কার,ইংরাজী গত ও রাগ রাগিণী | বেহালা-দর্পণ ও গণিত-সঙ্গীত

সঙ্গীতের যুক্তালঙ্কার , শ্রেষ্ঠালঙ্কার,ইংরাজী গত ও রাগ রাগিণী – ধাদী সম্বাদী প্রভৃতি অনুপাতে দুই তিনটা অঙ্গুকূল সুর একত্র বাদিত হইলে বে হুমধুর সুর প্রসূত হয়, তাকার নাম যুক্তালঙ্কার। ইহা ইউরোপীয় সঙ্গীতের পক্ষে যেরূপ অনন্য প্রধান ভূষণ, হিন্দু সঙ্গীতের অনুকূলে সেরূপ উপযোগী নহে। তথাপি গত কিম্বা আলাপাদি যাজাইবার সময় সাবধানে স্থান বিশেষে এই অলঙ্কারটা সংযোগ করিতে পারিলে মূর্তিটাকে নব নব বর্ণে সুরঞ্জিত করা যাইতে পারে। কিন্তু ইহার বাহুল্য ব্যবহার হারমোনিয়ম ও পিয়ানো যন্ত্রেই অধিক হইয়া থাকে। বেহালায় দুইটার অধিক সুর সংযোগ হয় না। যাহা হউক, নিম্নে উহার গুটীকতক সাধন মাত্র প্রদত্ত হইল।

যুক্তালকারের সাধনগুলি লিখিবার পূর্ব্বে হিন্দু সঙ্গীত-শাস্ত্রে সাতটা সুরের সহিত সাতটা : স্বর্ণের যেরূপ সাদৃশ্য উপমিত হইয়াছে? তাহা শিক্ষার্থিগণের অবগতির জন্য এই স্থানে লিখিত হইল; যথা-

কৃষ্ণ বর্ণো ভবেৎ ষড় জো, ঋষত সুকপিঞ্জরঃ।

 কনকাতপ্ত গান্ধারো, মধ্যঃ কুন্দ সমপ্রভঃ।

পঞ্চমন্ত ভবেৎ পীতো, ধূসরং ধৈবতং বিছঃ।

 নিষাদঃ শুকবর্ণস্যাৎ ইত্যতঃ স্বরবর্ণতা। নারদসংহিতা।

তথা বন্ত্রক্ষেত্রদীপিকা। 

অর্থাৎ যড়ঙ্গ কৃষ্ণবর্ণ, ঋষভ ধূম্র, গান্ধার সুবর্ণ, মধ্যম খেত, পঞ্চম হরিদ্রা, ধৈষত ধূসর এবং নিষাদ হরিৎ স্বর্ণের সহিত উপমিত। ইউরোপীয় সঙ্গীত শাস্ত্রেও ঠিক ঐ রূপ বর্ণিত আছে। কেবল, হিন্দুদিগের নিকট গান্ধার সুবর্ণ বর্ণ, ইউরোপীয়দিগের নিকট তাহা রক্ত বর্ণ এই সামান্য মাত্র বিশেষ। 

সুচতুর শিক্ষার্থিগণ বর্ণদিগের অনুকুল মিলনের প্রতি দৃষ্টি রাখিয়া স্থর সংযোগ করিতে পারেন। সুর ও বর্ণ পরম্পরার শ্রবণ ও নয়নানন্দজনক মিলনেব নাম অনুকূল মিলদ ও বিরক্তিকর মিলনের নাম প্রতিকূল মিলন। ইউরোপীয় ভাষায় যথাক্রমে ঐ দুইটা মিলনকে কনকর্ড (concord) ও ডিসকর্ড (discord) কছে। যাহা হউক, যুক্তালঙ্কার গ্রন্থনে বাদী সম্বাদী আদি পুত্র ব্যবহার করিলেই সফল আঁশা পূর্ণ হইবে।

সঙ্গীতের যুক্তালঙ্কার , শ্রেষ্ঠালঙ্কার,ইংরাজী গত ও রাগ রাগিণী

সাধন।

ছড়ের একটানে দুইটা স্বর প্রকাশ হইবে।

 

সঙ্গীতের যুক্তালঙ্কার

 

মধ্যম ভায়ে কনিষ্ঠ অঙ্গুলী যোগে সন্ন এবং স্থর ভারে ঐ অঙ্গুলীতে কী বাহির হইবে।

সঙ্গীতের যুক্তালঙ্কার

 

শ্রেষ্ঠালঙ্কার বা ছেড়।

বেহালা যন্ত্রে ছেড়ের সাধারণ সংজ্ঞা পরস্। তালিম, সুরল ও নিপুণ হস্তে ইহা বহুবিধ প্রকারে অনুষ্ঠিত হয়। গত, গান, আলাপ প্রভৃতি সর্ব্ব সঙ্গীতেই উহা প্রযুক্ত হইতে পারে। একটা সাধারণ লক্ষ্ণৌ ঠুংরী গানে সোপান স্বরূপ তিন প্রকার ছেড় লিখিল্ক হুইতেছে। এই সূত্রাবলম্বনে যত্ন করিলে বিবিধ ছন্দের ছেড় হস্তগত হইবে।

সাধন।

 ১ম প্রকার ।           সাধারণ ছেড়।

সঙ্গীতের যুক্তালঙ্কার

 

দা দি রি ইত্যাদি শব্দগুলিকে ছেড়ের বোল কহে। সুতরাং, ইহাতে আগত বিশ্বভ টানের নিয়ম খাটবে না।

২য় প্রকার।           দুন্ ছেড়।

সঙ্গীতের যুক্তালঙ্কার

সঙ্গীতের যুক্তালঙ্কার

সঙ্গীতের যুক্তালঙ্কার

 

ইহার এক মাত্রার স্বর চারিটাকে অর্দ্ধ মাত্রায় বাজাইলে, তাহাকে চৌহুল ছেড় কহে।

৩য় প্রকার।                        আড়ি ছেড়।

সঙ্গীতের যুক্তালঙ্কার

সঙ্গীতের যুক্তালঙ্কার

 

ইংরাজী গত।

FAIRY LAND বা নাচের গত।

নি-খ্যাফ্টা।

সঙ্গীতের যুক্তালঙ্কার

২য় ভাগ

সঙ্গীতের যুক্তালঙ্কার

 

ROSE. (সমাধি সঙ্গীত)

নি গ । বিলম্বিত মাত্রা।

সঙ্গীতের যুক্তালঙ্কার

 

এই গতটাতে যে কয়টী পদ, সেই কয়টা ছেদ দেওয়া হইয়াছে; কিন্তু, তাহাতে মাত্রার সমতা নাই, এই জন্য হিন্দু সঙ্গীতের কোন তালে ইহা সঙ্গত হইবে না।

GOD SAVE THE QUEEN,

 অর্থাৎ মহারাণীর মঙ্গল প্রার্থনাসূচক শেষ-সঙ্গীত।

 বিলম্বিত মাত্রা।

সঙ্গীতের যুক্তালঙ্কার

 

রাগ রাগিণা।

শ্রবণ ও হৃদয়রঞ্জনকর স্বরচিত শুরপরস্পরার নাম রাগ রাগিণী। বড়জকে আশ্রয় করতঃ আর আর স্বরগুলি ফোন নিয়মিত অনুপাতে আরোহণ পূর্ব্বক গ্রাম পূর্ণ করিয়া, পুনয়ায় ঐরূপ কোন অনুপাতে অবরোহণাস্তে পূর্ব্বস্থানে আসিয়া বিশ্রাম করে। ইহাতে যেন একটা পদ বা মূর্ত্তি গঠিত হয়।

ইহাই রাগ রাগিণীর বিশুদ্ধ ভাব। ঐ বিশুদ্ধ কাঠায়টী স্থির রাখিয়া উহাকে আবার’ নানা বর্ণালঙ্কার দানে মোহিণী মূর্ত্তিতে পরিণত করিতে হয়। যাহা হউক, ঐরূপ স্বরানুপাত বিভিন্নতায় বিবিধ রাগ রাগিণীর সৃষ্টি হইয়াছে। তাহাদিগের মধ্যে যে গুলির সুর পুরুষোচিত গম্ভীরতা ব্যঞ্জক, তাহারা পুরুষজাতীয় অর্থাৎ রাগ। 

যাহাদিগের সুর প্রেম বাৎসল্য আদি স্ত্রীজাতি স্থলভ কোমলতায় পরিপূর্ণ, তাহারা স্ত্রীজাতি অর্থাৎ রাগিণী। এই সকল রাগ রাগিণী আবার কুলগত ভাগত্রয়ে বিভক্ত হইয়া শুদ্ধ, সালঙ্ক ও সঙ্কীর্ণ অভিধানে অভিহিত হইয়াছে। যে সকল রাগ (১) স্বয়ংসিদ্ধ অর্থাৎ অমিশ্র ভাবে স্বয়ন্ডুরূপে উদিত হইয়াছে, তাহারা শুদ্ধ কুল। যে সকল রাগ দুইটা রাগ হইতে প্রস্থত, তাহারা সালঙ্ক ফুল, এবং যাহার।

 বহুরাগ হইতে উৎপন্ন, তাহারা সঙ্কীর্ণ কুল বলিয়া কথিত হয়। পুনশ্চ, ঐ সকল রাগ রাগিণী আবার সম্পূর্ণ, খাড়ব ও ওড়ব এই ত্রিবিধ শ্রেণীতে বিভক্ত হইয়াছে। যে সকল রাগে সাতটা শুরই ব্যবহৃত হয়, তাহা সম্পূর্ণ; যে যে রাগে ছয়টা সুর আবশ্যক হয়, তাহা খাড়ব এবং পাঁচ স্তরের রাগদিগকে ওড়ব শ্রেণী কছে।

রাগ রাগিণীদিগের মধ্যে যে সুরটা রাজার ন্যায়, অর্থাৎ যে স্থরটী সর্ব্বদা প্রয়োজনীয় ও গুরুমাত্রাবিশিষ্ট, তাহাকে বাদী, অংশ ও হিন্দি ভাষায় জান কহে। যে সুরটা মন্ত্রীর ন্যায় রাজার সঙ্গে সঙ্গে প্রায় থাকে অথচ বাদী অপেক্ষা মাত্রায় লঘু, তাহাকে সম্বাদী এবং যাহারা ভূত্যের ন্যায় মধ্যে মধ্যে আবশ্যকীয় এবং মাত্রায় অতি লঘু, তাহাদিগকে অনুবাদী কছে।

যে শুর’ শত্রুর ন্যায় রাগের মুর্ত্তি বিনাশ করে, তাহার নাম বিবাদী সুর। যে সুর গ্রহণ করিয়া রাগ আরম্ভ করিতে হয়, এবন্ধ যে স্থরে গিয়া বিশ্রাম করে, তাহাদিগের নাম ‘যথাক্রমে গ্রহ ও ন্যাশ সু ইহা ভিন্ন শাস্ত্রে রাগ ছাপিপীদিগের এক একটা মুর্ত্তিগত ব্যান শাহছ। আলাপের সময় সেই দুত্তিটা হৃদয়ে ধারণা করিয়া সঙ্গীত করিতে হইবে, ইহাই শাস্ত্রকারদিগের উদ্দেশ্য। ইহা তাঁহারা বৃথা অর্ধশূন্য বাক্যের ন্যায় লিখেন নাই। আমাদিগের ক্ষীণ মন্ত্রিক সেই নিভৃত স্থলে উপনীত হইতে না পারিলেও উহার অন্তস্তলে অতি মূল্যবান সত্য নিহিত আছে। বাহা হউক, এছলে কেবলমাত্র তৈঁর রাগের ধ্যানটী উদ্ধৃত হইল।

ভৈর বা ভৈরব রাগের ধ্যান।

গঙ্গাধরঃ শশীকলা ণ্ডিলফ স্ক্রিনেত্রঃ সর্পৈ বিতৃষিত তফু গজকৃতি বাসা ভান্ম এশূল ফর এষ রুদ্রাক্ষধারী গুঞ্জাঘরো জয়তি ভৈরব আদি রাগঃ।

সঙ্গীত রত্নাকর।

এই রাগের ধ্যান ও ধারার একটা পুরাতন বঙ্গানুবাদ।

ভয়রে। আদি রাগ শিবের বেশ।   শিব অবয়ব গুণে বিশেষ ।।

 ভুজঙ্গ নিন্দিত শিরেতে জটা।   জটায় বেড়িয়া ভুজঙ্গ ঘটা এ

হিল্লোল কল্লোল তরঙ্গ বায়।  ঝর ঝর গঙ্গা ঝরিছে তায়।

তাল শোভা হরিতাল তিলকে। সুধাংশু কলা কপাল ফলকে।

আসন বসন বাঘেব ছালা।  দল মল দোঁলে মুণ্ডের মালা।

কোটা শশধর জিনিয়া কায়।  তাহাতে বিভূতি কলঙ্ক পায়।

বৃষভ বাহন করে ত্রিশূল।  অক্ষির ভাৰ ঢুলু ঢুলু চুল।

সম্পূবণ ভাবে বেড়ান ফিরি। ধৈবত গান্ধার হরেতে গিরি।

ঋষভ সম্বাদী গান্ধার বাদী।  খবজ তাহাতে হবে অস্বাদী।

ছয় দণ্ড নিশি থাকিতে গাবে। অরুণ উদ্বয়ে সমাধা পাবে।

 

পাস্ত্রে ও ব্যবহারে রাগ রাগিণীদিগের আলোচনা করিবার যেরূপ সময় নিরূপিত – আছে, নিয়ে তাহাদের মধ্যে কতকগুলি প্রচলিত রাগ রাগিণীর তালিকা প্রদত হইল।

দিবা।

প্রভাত হইতে বেলা চারি দণ্ড পর্য্যন্ত। > ভৈরব, রামকেলী, বোগিয়া, ভৈরবী, আশাবরী, ভাটিয়ারি ও খট্ প্রভৃতি।

চারি দণ্ড হইতে বেলা মশ দণ্ড পর্য্যন্ত। >  বিভাষ, আলেয়া, পটমঞ্জরী, দেবগিরি, কুকুত ইত্যাদি।

দশ দণ্ড হইতে বেলা। দুই প্রহর “পর্য্যন্ত। >  সিন্ধু, কাফিসিন্ধু, সিন্ধু বিজয়, টোড়ী, গুজরাটা টোড়া, বাহাদুরি টোড়াঁ ইত্যাদি দ্বাদশ টোড়ী।

দুই প্রহর হইতে তৃতীয় প্রহর পর্য্যন্ত। >  সারং, বৃন্দাবনী সারং, মধুমাধবী প্রভৃতি সপ্তসারং।

তৃতীয় প্রহর হইতে সূর্য্যান্ত পৰ্য্যন্ত। > মুলতানী, ভীমপলশ্রী, রাজবিজয়, বারোঁয়া, পিলু, ধানী পূরবী, পুরিয়া, ধানেশ্রী ইত্যাদি।

রাত্রি।

সন্ধ্যা হইতে রাত্রি চারি দণ্ড পর্য্যন্ত।  >  শ্রীরাগ, গৌরী, মাড়োয়া, হাব্বির, কেদারা, কল্যাণী, কামোদী, ছায়ানট ইত্যাদি।

চারি দণ্ড হইতে দশ দণ্ড পর্য্যন্ত। > ইমন, ভুপালী, ইমনকল্যাণ, জয়জয়ন্তী, বাগীশ্বরী, দরবারী প্রভৃতি অষ্টাদশ কানাড়া।

দশ দণ্ড হইতে দুই প্রহর পর্য্যন্ত। > ঝিঁঝিঁট, গাম্বাজ, পরজ, কালাংড়া, আড়ানা, সাহানা ইত্যাদি।

দ্বিতীয় প্রহর হইতে তৃতীয় প্রহর পর্য্যন্ত। > বেহাগ, বেহাগ খাম্বাজ, বিহঙ্গড়া, শঙ্করা, শঙ্করাভরণ, নটনারায়ণ ইত্যাদি।

তৃতীয় প্রহর হইতে প্রভাত পর্য্যন্ত। > মালকোশ, হিঙোল, সোহিনী, ললিত ইত্যাদি।

ইহা ভিন্ন কোন বিশেষ ঋতু সমাগমে, অথবা কোন সাময়িক ঘটনায়, বিশেষ বিশেষ রাগ রাগিণী গীত হইবার প্রথা প্রচলিত আছে; যথা-আনন্দ উৎসবের সময় আড়ানা, সাহানা, শ্যাম ইত্যাদি। বসন্ত ঋতুতে বসন্ত, বাহার, সোহিনী, হিণ্ডোল, মালকোশ ইত্যাদি। বর্ষা ঋতুতে মোল্লার, মেঘ, সুরট, জয়জয়ন্তী, দেশ ইত্যাদি রাগ গীত হইয়া থাকে।

আরও পড়ুনঃ

Leave a Comment