সঙ্গীতের বেহালা – আজকের আলোচনার বিষয়। এই পাঠটি “বেহালা-দর্পণ ও গণিত-সঙ্গীত” বিষয়ের একটি পাঠ। বেহালা একধরনের বাদ্যযন্ত্র যা ধনুক তন্তুর সম্মিলনে সুর সৃষ্টি করে। সাধারণত এগুলো চার পঙ্ক্তি এবং নিখুঁত টিউনের জন্য পাঁচ পঙ্ক্তির হয়ে থাকে। এটা ক্ষুদ্রতম, পঙ্ক্তি যন্ত্রের বেহালা পরিবার, যা বেহালাজাতীয় বীণাবিশেষ, বাদ্যযন্ত্রবিশেষ, এবং দ্বৈত খাদ অন্তর্ভুক্ত সর্বোচ্চ ত্ত তীক্ষ্ন স্বরবিশিষ্ট সদস্য। বেহালা সঙ্গীতের সহযোগী হিসাবে বা যন্ত্রসঙ্গীত পরিবেশনার জন্য ব্যবহৃত হতে পারে।
সঙ্গীতের বেহালা

বেহালা
আমাদিগের দেশে যে সকল যন্ত্র বাদিত হয়, বেহালা যে তাহাদিগের মধ্যে শ্রেষ্ঠ, ইহা প্রায় সকলেই অবগত আছেন। বিশেষতঃ অধিক কার্যোপযোগিতায় ইহার সহিত অন্য কোন যন্ত্রই সমকক্ষতা লাভ করিতে পারে না। ইহাতে ইংরাজী গত, নেহারার গত, কন্সার্টের গত, খেয়াল, টপ্পা, আলাপ প্রভৃতি সঙ্গীত আলোচনার যাবতীয় অঙ্গগুলি অতি সুন্দররূপে সম্পন্ন হইয়া থাকে।
ক্লারিয়নেট, রুট, এবং হারমোনিয়ম প্রভৃতি যন্ত্রের সহিত, ইহার যে অতি পবিত্র প্রণয়, তাহা সকলেই শ্রবণ করিয়াছেন। আবার দূরগামী শব্দে বেহালার একাধিপত্য কেহই অস্বীকার করিতে পারিবেন না; এবং তাহা যে কিরূপ সুধাবৃষ্টি করে, যিনি নিশীথ সময়ে অথবা রজনীর শেষযামে সুরল হস্ত-বাদিত বেহালার আলাপ দূর হইতে শ্রবণ করিয়াছেন, তাঁহারই হৃদয়-ক্ষেত্র তাহার মধুরতা প্রমাণের একমাত্র সাক্ষ্যস্থল। সুতরাং, ইহা অবশ্য বল।
যাইতে পারে যে, বীণা বলিয়া যদি স্বতন্ত্র কোন যন্ত্র থাকে, তবে তাহা বেহালা। এই জন্য, ব্যবহারেও কি এসিয়া, কি ইউরোপ অথবা আমেরিকা কিম্বা অষ্ট্রেলিয়া, পৃথিবীর সকল দেশের কি ধনী, কি নির্ধন, কি মধ্যবিত্ত, সকলেই সমান আদরে সকল সমাজে অর্থাৎ কি যাত্রা, কি নাচ, কি থিয়েটার, কি বৈঠকি, সঙ্গীত আলোচনার সকল স্থানেই এই সুমিষ্ট সুরপ্রসবিনী বেহালাকে অতি যত্নপূর্ব্বক গ্রহণ করিয়া থাকেন। মূল্য সম্বন্ধেও বেহালা সকলের উচ্চ স্থান অধিকার করিয়াছে। মণি-মাণিক্যবিহীন, অর্দ্ধসের মাত্র নীরস দারুময় দেহ এক খানি বেহালার মূল্য পঞ্চবিংশতি সহস্র মুদ্রা, ইহা অনেকেই শ্রবণ করিয়াছেন।

কিন্তু ইহা শ্রবণে যেমন মধুর, অভ্যাস করিতে তেমনই পরিশ্রম আবশ্যক করে। সেতার, এস্ট্রার আদি যন্ত্রে পর্দা বাঁধা আছে, সুতরাং পর্দায় পর্দায় অঙ্গুলি দিয়া গেলে কু-দুর বাহির হইবার সম্ভাবনা নাই। কিন্তু বেহালায় তাহার সম্পূর্ণ বিপরীত। অল্প পরিসর স্থানের মধ্যে অদৃষ্ট পর্দাগুলি বিদ্যমান রহিয়াছে, অঙ্গুলি সকল সূত্র পরিমাণ স্থান ভ্রষ্ট হইলে অমনি কু-সুর বাহির হইয়া যায়। এই জন্য, বেহালা-বাদকগণের হস্তে মিষ্ট স্থর আসিতে বিশেষ কষ্টকর ও কালবিলম্ব হইয়া পড়ে।
অনেকের বিশ্বাস, বেহালায় রাগের আলাপ হইতে পারে না; কিন্তু এরূপ ধারণা অতি ভ্রমাত্মক। রাগের প্রধান উপাদান গমক, মুচ্ছ না, তান, গিল্ফিরি আদি, অখন এই যন্ত্রে বিশুদ্ধরূপে সম্পন্ন হয়, তখন রাগের আলাপ যে কি জন্য হইবে না, তাত্ত্বা বুঝিতে পার। যায় না। তবে ইহা অবশ্য বলা যাইতে পারে যে, যন্ত্র বিশেষে যেরূপ গম্ভীর শব্দ নিঃসৃত হয়, ইহাতে সেরূপ হয় না। কিন্তু তাহা বলিয়া যে রাগের পূর্ণতা রক্ষিত হইবে না, ইহা অতি ভ্রমাত্মক সংস্কার। কোন কোন যন্ত্রে মুচ্ছ’না আছে, গিট্টুরী ভাল বাহির হয় না।

কোন যন্ত্রে গিটকিরী আদি সুসম্পন্ন হইতে পারে, মুচ্ছ’না কার্য্য একেবারেই প্রকাশ হয় না। কিন্তু এক বেহালা যন্ত্রে সমস্ত অলঙ্কারই শোভা পাইয়া থাকে। সুর ও পূর্ণ তিনগ্রাম বিদ্যমান থাকায়, উক্ত তিন গ্রামেই রাগাদির মূর্ত্তি অতি পরিষ্কার রূপে প্রতিফলিত হয়। আবার বাদকের সুবিধা দেখিতে গেলে, বেহালার সদৃশ যন্ত্র আর দৃষ্ট হয় না। শয়নে, উপবেশনে, দণ্ডায়মানে অথবা ভ্রমণে কিম্বা অশ্বা- রোহণে সকল অবস্থাতেই উহাকে সমানভাবেই বাজাইতে পারা যায়। ফলতঃ, ওজনে লঘু, শব্দে গুরু এবং তন্তু চারিটি মাত্র ও তাহাতেই সমস্ত কার্য্য শেষ, এমন উপাদেয় যন্ত্র আর কি হইতে পারে?
১ thought on “সঙ্গীতের বেহালা | বেহালা-দর্পণ ও গণিত-সঙ্গীত”