শ্রুতি বিভাগ | বেহালা-দর্পণ ও গণিত-সঙ্গীত

শ্রুতি বিভাগ – সাতটা প্রাকৃতিক স্বরের গ্রামকে বিশুদ্ধ অথবা প্রকৃত গ্রাম কহে। কিন্তু সাতটা স্ব রের ঐরূপ প্রাকৃতিক অনুপাত হইতে বিবিধ রসের বহুবিধ রাগ রাগিণীর মুর্ত্তি গুলি প্রতিফলিত হয় না। এই জন্য, আর্য্য ঋষিগণ ঐ সপ্তস্বর নিচয়ের মধ্যে কোমল তীব্রাদি পাঁচটা অর্দ্ধ সুর সংযোগ করিয়া বারটা শুরে এটা বিকৃত গ্রাম স্থির করিলেন।

শ্রুতি বিভাগ

কিন্তু উহাতেও কুলাইল না; স্বপ্নরূপে সুর প্রবাহের সুসংযোগ সাধিত হইল না। অনন্তর তাঁহারা ঐ গ্রাম দণ্ডকে খণ্ড খণ্ড করিয়া অনুকোমল, মধ্য কোমল, অতি কোমল, তীব্র ও অতি তীব্রাদি বাইশূটী সূক্ষ্মতম সুরে একটা বিস্তৃত গ্রাম কল্পনা করিলেন। ঐ কল্পিত খণ্ড সুরগুলির নাম শ্রুতি এবং ঐ শ্রুতিময় গ্রামের নাম শ্রৌতিক গ্রাম। শ্রুতি সকল যথাক্রমে ষড়জে ৪, ঋষভে ৩, গান্ধারে ২, মধ্যমে ৪, পঞ্চমে ৪, ধৈবতে ৩ ও নিষাদে ২টা; সর্ব্বশুদ্ধ এই বাইশটী মাত্র।

শ্রৌতিক গ্রাম

 

শ্রুতি বিভাগ

 

—————————————————————————

এখন হইতে দুরগুলির নিম্নে উদারা গ্রামসূচক বিন্দু বেগুণ। হইবে না। কেননা সা কে যে গ্রাম হইতে ইচ্ছা, এক ধরিয়া হিসাব করিলে নিম্ন গ্রাম তাহার অন্ধ’ ও উচ্চ গ্রাম দ্বিগুণ পরিমাণবিশিষ্ট হইবে।

 

শ্রুতি বিভাগ

 

এই গণনা দ্বারা স্পষ্টই দেখা যাইতেছে যে, সমস্ত স্বরগত শ্রুতিগুলির পরিমাণ ঠিক সমান নহে। এই জন্য যদিও শ্রুতিনিচয়ের পরস্পর তরঙ্গগত সংমিলন সম্পূর্ণ সূক্ষ্মরূপে সাধিত হয় না, কিন্তু তাহা বলিয়া ব্যবহার-সঙ্গীতে ইহা অপেক্ষা আরও অধিক পরিমাণে শ্রুতি কখনই চলিতে পারে না। তথাপি আৰ্য্য ঋষিগণ ছাড়িবার পাত্র ছিলেন না। ধন্ত ক্ষণ পর্য্যন্ত তাঁহাদিগের সেই স্বপ্ন ইন্দ্রিয়-জ্ঞানের সহিত বাহু বস্তুর সুসংযোগ না হইয়াছে, তত ক্ষণ তাঁহারা চিন্তাশূন্য হইতে পারেন নাই। অতি স্বপ্ন শ্রবণ-শক্তির শুণে তাঁহারা শ্রুতিদিগের তরঙ্গগত সামান্য তারতম্য বুঝিতে পারিয়া, তাহা দূর করিবার জন্য, বীণাদি তার-যন্ত্র স্বজন করিলেন। তাহাতে আবশ্যকমত অঙ্গুলি আকর্ষণাদি দ্বারা

তাঁহাদিগের সমস্ত আশাই নিবৃত্তি হইতে লাগিল। শ্রুতিদিগের ঐ সকল সামান্য সংমিলন রক্ষিত হইবে বলিয়াই ভারতবর্ষে সচল সারিকাযুক্ত তার-যন্ত্রের এত বাহুল্য বিস্তার। যে দেশবাসী লোক যত স্বল্প সুরের পার্থক্য অনুভব করে, সে দেশবাসী লোকের শ্রবণ শক্তি যে তত অধিক ও স্বপ্ন, ইহা অবশ্যই স্বীকার করিতে হইবে।

ভারতে এক এক গ্রামে বাইশটী সুর, ইউরোপাদি দেশে বারটী। ইহাতেই অনুভব করিতে পারেন, কোন্ দেশীয় লোকের শ্রবণ শক্তি কত স্বপ্ন বা স্থূল। সেই জন্য বলি, আপনি পুণ্যফলে ভারতে জন্মগ্রহণ করিয়াছেন, অত এব যুদি সুচতুর ও সুরসিক গায়ক অথবা বাদক হইতে ইচ্ছা করেন, তবে পুরাতন ঋষিদিগের প্রদর্শিত শ্রুতিগুলির প্রতি বিশেষ দৃষ্ট রাখিবেন।

যিনি যতই সুর ঠিক করিতে পারিবেন, তিনি ততই গন্তব্য স্থানের নিকটবর্তী হইবেন। ভারতের সঙ্গীত, নাদ সমুদ্র-মস্থিত অমৃত ভাণ্ড-ইহা হেলায় হারাইবেন না। আপনার প্রতিবাস- মণ্ডলীতে বীণা, বেহালা, সেতার, এসরারাদি বহুবিধ সুমিষ্ট যন্ত্রসকল প্রস্তুত রহিয়াছে; সেই সকল দেশীয় যন্ত্র পরিত্যাগ করিয়া বিজাতীয় গন্ধযুক্ত হারমোনিয়ম, ক্লারিয়নেট, কণেট প্রভৃতি মোটা ও অসম্পূর্ণ সুরের যন্ত্র আলোচনা করিয়া, পূর্ব্ব পুরুষদিগের শত সহস্র বৎসরের অভ্যাস ফলে যে স্বপ্ন পুর জ্ঞানের উত্তরাধিকারী হইয়াছেন, তাহা ক্ষোয়াইবেন না। বিজাতীয় যন্ত্রে এমন সুক্ষ্ম শুর নাই যাহা আপনার মর্ম্মস্থল পর্য্যন্ত স্পর্শ করিতে পারে।

 

বেহালা-দর্পণ ও গণিত-সঙ্গীত সূচিপত্র

 

হিন্দু সঙ্গীত যেমন উপাদেয়, তেমনই জটিল, বিস্তৃত ও বিবিধ প্রকৃতিবিশিষ্ট। সহজে ও স্বল্লায়াসে তাহার মর্ম্মোঘাটন করা নিতান্ত দুরাশা; তথাপি শুচতুর শিক্ষার্থীদিগের অভিধান স্বরূপ ইহার সহিত একটা দ্বাবিংশতি শ্রুতিবিশিষ্ট স্বর-গ্রাম-চিত্র প্রদর্শিত হইল। অভিনিবেশ পূর্ব্বক দৃষ্টি করিলে, উহাতে আবশ্যকমত বিবিধ স্বরজ্ঞান কৌশল উপলব্ধ হইবে। এক এক ঘরে এক একটা করিয়া যে দ্বাবিংশতি শ্রুতি অঙ্কিত হইয়াছে, উহাদের 每কলেরই কিছু গ্রামত্ব অর্থাৎ গ্রাম সংস্থাপন ক্ষমতা নাই। হিন্দু সঙ্গীতে ষড়জ পরিত্যাগ করিয়া কোন রাগ বা গীতাদি হইতে পারে না। সুতরাং যে রূপেই গ্রাম স্থির করুন, ষড়জকে এক স্থলে রাখিতেই হইবে। তা

হা হইলে ষড়জকেঋরমসম্বনি এই ছয়টা প্রাকৃতিক স্বরে স্থাপন করিয়া ঐ ছয়টা মাত্রই গৌণ-গ্রাম নিষ্পন্ন হইতে পারে। ইহার মধ্যে পঞ্চমের ও মধ্যমের প্রাধান্যই বেশী। অভিনিবেশ পূর্ব্বক চিত্রটা দর্শন করিলে তাহার অর্থ বুঝিতে পারিবেন। ফলে, আপনি পঞ্চমকেই সুর করুন অথবা মধ্যম কিম্বা অতি কোমল নিষাদাদিকেই সুর করুন, শ্রুতি বিভাগগুলি ঠিক করিয়া স্বরদিগের প্রাক্ক- তিক পৰ্য্যায় বক্তায় রাখিবেন, ইহাই শ্রৌতিক-গ্রাম প্রদর্শনের প্রধান উদ্দেশ্য।

আরও পড়ুনঃ

1 thought on “শ্রুতি বিভাগ | বেহালা-দর্পণ ও গণিত-সঙ্গীত”

Leave a Comment